Saturday 13 August 2011

মুক্তির গান এবং চিরতরে মুক্তি.........।।





### সাল ১৯৮৯ ###: ছবি লাগবে;ছবি?এই বলে বাংলাদেশ টেলিভিশনের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন একজন সুপুরুষ। নানা অজুহাতে তাকে প্রতিদিন ফিরিয়ে দিতে থাকেন কর্তব্যরত কর্মকর্তারা। তারপরেও দমে যাননি সেই ব্যক্তিটি।প্রস্তাব দেন বিনামূল্যে হলেও তার চলচিত্রটি প্রদর্শনের জন্য।কিন্তু না,পাষাণ কর্মকর্তার হৃদয় গলে না।গুণী চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানকে নিয়ে নির্মিত ছবি "আদম-সুরাত" এর ফিল্মগুলো পরে থাকে কোন অন্ধকারাচ্ছন্ন বেসমেন্টে। 


### সাল ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ ###: আবারো একই ব্যক্তির আগমন দৃশ্যপটে। এবার আর তিনি "Mr. Nobody" নন। পুরাদস্তুর একজন চলচিত্র নির্মাতা হিসেবে নিজের জায়গা করে নেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে। "তারেক মাসুদ" নামটি তখন আস্তে আস্তে গণমানুষের কাছে পরিচিত হচ্ছে। 


১৯৭১ সালে মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধের উপর একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণের অভিপ্রায়ে এদেশের একদল সাংস্কৃতিক কর্মীর সঙ্গ নেন। 'বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা' নামের দলের এই সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করতেন। এই শিল্পীদের সাথে থেকে লেভিন প্রায় ২০ ঘণ্টার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। 

দীর্ঘ দুই দশক পর ১৯৯০ সালে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ নিউইয়র্কে লেভিনের কাছ থেকে এই ফুটেজ সংগ্রহ করেন। এ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তারা আরো বিভিন্ন উৎস থেকে মুক্তিযুদ্ধের নানা সংরক্ষিত উপাদান সংগ্রহ করেন, বিশ বছর আগের সেই শিল্পীদের সাথে যোগাযোগ করেন। এভাবেই তিনি সেই একাত্তর সালের সত্যিকার ফুটেজ দিয়ে তৈরি করেন "মুক্তির গান"।  


শুধু ছবি নির্মাণ করেই থেমে থাকেন নি,এই ছবি যাতে দেশের প্রত্যন্ত এলাকার সেইসব মানুষের কাছে পৌঁছে,সে কারণে তিনি নিজ কাঁধে প্রজেক্টর বহন করে নিয়ে তার এই ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করেন গ্রামের সাধারণ মানুষগুলোকে। মুক্তিযুদ্ধের কথা এবং চেতনার পুনর্জাগরণ ছিল তার উদ্দেশ্য। আর এই ছবি দেখে মানুষদের মাঝে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া ধারণ করে তিনি তার "মুক্তির কথা" ছবিতে। "Time is the best healer",এই প্রবাদকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন "মুক্তির কথা" দিয়ে।বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে চান একাত্তরের গণহত্যা,আজো আমাদের মাঝে প্রাসঙ্গিক;আজো যার বিভীষিকা সেই গণহত্যার সাক্ষী মানুষগুলোর দুঃস্বপ্নে তাড়া করে বেড়ায়। 
                                                   

###সাল ২০০২###: এবার তার প্রতিভাকে শুধু দেশের সীমারেখার মাঝে আটকে রাখা যায় নি। "মাটির ময়না" চলচিত্রের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক চলচিত্রাঙ্গনে সাড়া ফেলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালের পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মুসলিম পরিবারের জীবন প্রবাহের এক সার্থক সংকলন তার ২০০২ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত চলচিত্র "মাটির ময়না"(The Clay Bird)। পাকিস্তান আমলে মানুষের ধর্মান্ধতার এবং যুদ্ধের ফলে কিভাবে একটি পরিবার ধ্বংসের দিকে যেতে পারে- তার একটি চিত্র ফুটে উঠেছে চলচিত্রটির পরিচালক তারেক মাসুদের ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিচ্ছবি 'মাটির ময়না' চলচিত্রে। ৯৮মিনিটের এই চলচিত্রে উঠে এসেছে তারেক মাসুদের কৈশোরে মাদ্রাসায় পড়াশুনাকালীন সময়কার অভিজ্ঞতা এবং ধর্মান্ধতার শিকার এক কিশোরের মানসিক অভিজ্ঞতা।

 








কিন্তু আবারো যথারীতি তৎকালীন রাষ্ট্র যন্ত্রের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত ছবির এলার্জীর কারণে সেন্সর বোর্ড আটকে দেয় চলচিত্রটি। কি লজ্জা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যখন "মাটির ময়না" অর্জন করছে একটির পর একটি পুরস্কার তখন নিজ দেশেই তার প্রদর্শনের অনুমতি নেয়। এমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তার আপোষহীনতার পরিচয় দিয়ে তিনি মামলা করেন আদালতে।অবশেষে আদালত থেকে তার পক্ষে রায় দেওয়ার পর আবার দেশে মাটির ময়নার প্রদর্শন শুরু হয়। 


###সাল ২০০৬###: এবার নিয়ে আসলেন তিনি অনন্য একটি চলচিত্তর "অন্তর্যাত্রা"।, লন্ডন প্রবাসী এক সিলেটী পরিবারের গল্পের মাধ্যমে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিল এই ছবির মূল থিম। দেশকে তুলে ধরা,মানুষের মাঝে দেশপ্রেমকে বৃদ্ধি করা এবং দেশকে নিয়ে চিন্তা করা,এই ম্যাসেজগুলো দেওয়ার চেষ্টা তার ছবির মাঝে সবসময় ছিল।


 







###সাল ২০১০###: ইতিমধ্যে বাংলা মায়ের বুকে আঁচড় পড়েছে জঙীবাদের ভয়াল থাবার। একজন দেশপ্রেমিক আর সচেতন নাগরিক হিসেবে থেমে থাকেন নি তারেক মাসুদ।জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে নিয়ে আসেন তার নির্মিত ছবি "রানওয়ে"।,এই ছবি নির্মাণের পর বিভিন্ন হাল মালিক ও প্রযোজকদের নিকট থেকে অনেক অফার পেলেও তিনি ছবি নিয়ে আবারো ছুটে চলেন দেশের মানুষের কাছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিশোর,তরুণ যার ধর্ম ব্যবসায়ীদের সহজ শিকার,তাদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তিনি ছুটে চলেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।অর্থ-সম্প্রদ,যশ নয় সবার আগে যার কাছে সবসময় ছিল দেশ,দেশপ্রেম এবং দেশের মানুষ












নির্মিত চলচ্চিত্র ও ডকুমেন্টারি

নংনামক্যামেরাদৈর্ঘ্যমুক্তির সনপরিচালকনির্মাতাবিষয়
০১আ কাইন্ড অফ চাইল্ডহুডবেটাক্যাম এসপি৫০ মিনিট২০০২তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদজিঙ্গু ফিল্ম্‌স, অডিওভিশনঢাকার কর্মজীবী শিশুদের জীবন সংগ্রামের উপর ডকুমেন্টারি
০২মাটির ময়না৩৫এমএম৯৮ মিনিট২০০২তারেক মাসুদক্যাথরিন মাসুদষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের মাদ্রাসায় পরিচালকের বাল্য জীবনের অভিজ্ঞতার উপর পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র
০৩নারীর কথাবেটাক্যাম এসপি২৫ মিনিট২০০০তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদযুদ্ধে বেঁচে থাকা নারীদের অভিজ্ঞতার উপর ডকুমেন্টারি
০৪মুক্তির কথাবেটাক্যাম এসপি৮২ মিনিট১৯৯৯তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাধারণ গ্রামীণ জনগণের অভিজ্ঞতা
০৫ইন দ্য নেইম অফ সেফ্‌টিডিভিক্যাম২৫ মিনিট১৯৯৮তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদটিভিই লন্ডন, অডিওভিশনবাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘনের উপর ডকুমেন্টারি
০৬ভয়েসেস অফ চিলড্রেনবেটাক্যাম এসপি৩০ মিনিট১৯৯৭তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদইউনিসেফ, অডিওভিশনবাংলাদেশের কর্মজীবী শিশুদের উপর ডকুমেন্টারি
০৭মুক্তির গান৩৫এমএম৭৮ মিনিট১৯৯৬তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একটি ভ্রাম্যমান গানের দলের উপর পূর্ণ দৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র
০৮ইউনিসনইউম্যাটিক ভিডিও৪ মিনিট১৯৯৪মানবজাতির ঐক্যের উপর এনিমেশন চলচ্চিত্র
০৯সে৩৫ এমএম১০ মিনিট১৯৯৩তারেক মাসুদ, শামীম আখতারএকটি নারী ও পুরুষের বেদনাদায়ক পুনর্মিলন
১০আদম সুরত১৬ এমএম৫৪ মিনিট১৯৮৯তারেক মাসুদবাংলাদেশী শিল্পী এস এম সুলতানের জীবন ও শিল্পকলার উপর ডকুমেন্টারি
১১অন্তর্যাত্রাতারেক মাসুদলন্ডন প্রবাসী এক সিলেটী পরিবারের গল্পের মাধ্যমে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ








###১৩ আগস্ট,২০১১###: এই লেখাটি যখন লিখছি তখন হয়তো সেই সুদর্শন,সুপুরুষটির ঠাণ্ডা নিথর দেহটি পড়ে আছে কোন মর্গে,হাজারো লাশের মাঝে।তার সহধর্মিণী গুরতর আহত অবস্থায় আছেন হাসপাতালে। একই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক মিশুক চৌধুরী। 


আরও অনেক কিছুই দেওয়ার ছিল তার। তিনি এখন নেই।কাগজের ফুল আর ফুটলো না আমাদের মাঝে। এখন কে শোনাবে আবার মুক্তির গান?কে আবার তার চলচ্চিত্রের মাঝে আমাদের মধ্যে দেশপ্রেমকে উজ্জীবিত করবে?কেউ না। কারণ তারেক মাসুদের অভাব পূরণ করার নয়।আমাদের হৃদয়ের ঐ জায়গাটুকু সবসময় শূন্যয় থেকে যাবে। 


যেখানেই থেকো,ভালো থেকো তারেক মাসুদ। এমন দূর্ভাগা জাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করলে যারা তোমার জীবনের নিশ্চয়তাটুকু পর্যন্ত দিতে পারলো না। আমাদের কখনো তুমি ক্ষমা কোরোনা ।কারণ আমরা যে তোমার ক্ষমারো যোগ্য নই।

















Info Courtesy : মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোন [A Page totally based on liberation war'71]













1 comment:

  1. nirmito films & documntryr list ta dekhe mne holo arekbar Bangladesh ki haralo..emn ekjnk haralo jar karne international fest er puroshkar bd achieve koreche..Allah tar attar shanti dek..r edeshr manushr jibonr value somporke amdr jogajog bebosthapona committee arktu careful hok..

    ReplyDelete